September 8, 2024, 12:02 am

সাবেক অতিরিক্ত আইজিপির সীমাহীন দুর্নীতি, অবৈধ অর্থ যায় স্ত্রীর অ্যাকাউন্টে

যমুনা নিউজ বিডি: জ্ঞাত আয়-বহির্ভূত সম্পদ অর্জন ও মানি লন্ডারিংয়ের অভিযোগে সাবেক অতিরিক্ত আইজিপি শামসুদ্দোহা খন্দকার ও তার স্ত্রী ফেরদৌসী সুলতানা খন্দকারের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র জমা দিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এছাড়া বিআইডব্লিউটিএ’র চেয়ারম্যান থাকাকালীন ঐ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে সীমাহীন অনিয়ম, দুর্নীতি ও স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগ ওঠে।

মঙ্গলবার জমা দেওয়া অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে, শামসুদ্দোহা খন্দকার ও ফেরদৌসী সুলতানা খন্দকারের ‘অপরাধলব্ধ’ আয়ের পরিমাণ ৬২ কোটি টাকা। শামসুদ্দোহার চেয়ে তার স্ত্রীর ‘অপরাধলব্ধ’ আয় বেশি, পরিমাণ ৪১ কোটি টাকা। শামসুদ্দোহার ‘অপরাধলব্ধ’ আয় ২১ কোটি টাকা।

২০১৮ সালে পুলিশ কর্মকর্তা শামসুদ্দোহা ও তার স্ত্রীর অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ অনুসন্ধান শুরু করে দুদক। অনুসন্ধান শেষে জ্ঞাত আয়-বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগের সত্যতা পাওয়ায় তাদের বিরুদ্ধে ২০১৯ সালে মামলা করে দুদক। ৫ বছর তদন্ত শেষে মঙ্গলবার ঢাকা মহানগরের জ্যেষ্ঠ বিশেষ জজ আদালতে দুজনের বিরুদ্ধে পৃথক দুটি অভিযোগপত্র জমা দেওয়া হয়।

এদিকে অভিযোগপত্রে দুদক বলেছে, শামসুদ্দোহা সরকারি কর্মকর্তা থাকাকালে ক্ষমতার অপব্যবহার করে দুর্নীতির আশ্রয় নেন। দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত অবৈধ আয়কে বৈধ করার পূর্বপরিকল্পনা করেন তিনি। তার নিজের বেতন-ভাতা বাবদ আয়ের চেয়ে অনেক বেশি অর্থ জমা হয় স্ত্রী ফেরদৌসী সুলতানার নামে খোলা বিভিন্ন ব্যাংকে হিসাবে (অ্যাকাউন্ট)। তার স্ত্রী একজন গৃহিণী। শামসুদ্দোহার বেতন-ভাতার চেয়ে স্ত্রীর ব্যাংক হিসাবে জমা হওয়া অর্থের পরিমাণ ৪১ কোটি ২৯ লাখ টাকা বেশি। আর শামসুদ্দোহার ব্যাংক হিসাবে জমা হয় ২১ কোটি ৫ লাখ টাকা।

বিআইডব্লিউটিএ’র চেয়ারম্যান ছিলেন শামসুদ্দোহা খন্দকার
১৯৮৬ সালে সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) হিসেবে পুলিশে যোগ দেন শামসুদ্দোহা। ২০১১ সালে অতিরিক্ত আইজিপি হিসেবে পদোন্নতি পান। ২০১১ সালে তাকে প্রেষণে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) চেয়ারম্যান পদে নিয়োগ দেয় সরকার। দায়িত্ব পাওয়ার পর তার বিরুদ্ধে সীমাহীন অনিয়ম, দুর্নীতি ও স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগ ওঠে। এরপর ২০১৫ সালে তাকে বিআইডব্লিউটিএ’র চেয়ারম্যান পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। ২০১৬ সালের ৩ মার্চ তিনি পুলিশ থেকে অবসরে যান।

শামসুদ্দোহার তিনটি ব্যাংক হিসাবে প্রায় ২৯ কোটি টাকা জমা হওয়ার তথ্য পেয়েছে দুদক। এর মধ্যে অবসরে যাওয়ার দুই মাস আগে (২০১৫ সালের ৩০ ডিসেম্বর) ঢাকার একটি বেসরকারি ব্যাংকে হিসাব খোলেন শামসুদ্দোহা। ২০২২ সালের ২৮ এপ্রিল পর্যন্ত ঐ হিসাবে জমা হয় প্রায় ১৪ কোটি ১৪ লাখ টাকা।

দুদক বলছে, একটি ব্যাংকের ঢাকার নবাবগঞ্জ শাখা থেকে শামসুদ্দোহা ও তার স্ত্রীর যৌথ মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান অর্গানিক এগ্রো ফার্মসের নামে ৭ কোটি ৯০ লাখ টাকা ঋণ নেয়া হয়। প্রতিষ্ঠানটির অবকাঠামো তৈরির কাজে ব্যয় করা হয় ১ কোটি ৩০ লাখ টাকা। বাকি অর্থ তার স্ত্রীর ব্যাংক হিসাবে স্থানান্তর করা হয়।

অর্গানিক এগ্রো ফার্মস নামে কোনো প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব না পাওয়ার তথ্য আদালতকে জানিয়েছে দুদক। তারা বলেছে, ২০১২ সাল থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত শামসুদ্দোহার ব্যাংক হিসাবে ঋণের অর্থ বাদ দিয়ে লেনদেনের পরিমাণ ২১ কোটি টাকার কিছু বেশি।

দুদকের অভিযোগপত্রে বলা হয়, এই লেনদেন একজন সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে তার বেতন-ভাতাদির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। ব্যাংক হিসাবে এই লেনদেনের অর্থের উৎসের পক্ষে দুদকে তিনি কোনো প্রমাণ জমা দেননি।

এদিকে শামসুদ্দোহা ঢাকার গুলশানের ১৩৫ নম্বর সড়কে একটি সরকারি বাড়ি দীর্ঘদিন ধরে দখল করে রেখেছেন। সাত দিনের মধ্যে বাড়িটি ছাড়ার জন্য তাকে গত ১৫ মে নোটিশ দেয় সরকারি আবাসন পরিদফতর। কিন্তু সূত্র বলছে, তিনি বাড়িটি ছাড়েননি।

স্ত্রীর হিসাবে ৪১ কোটি টাকা
দুদকের অভিযোগপত্রে বলা হয়, শামসুদ্দোহার স্ত্রী ফেরদৌসী সুলতানার আয়ের কোনো উৎস নেই। অথচ তার ৬টি ব্যাংক হিসাবে ৪১ কোটি ২৯ লাখ টাকা জমা হওয়ার তথ্য-প্রমাণ পাওয়া গেছে। তার নামে ২০১২ সালের ২৯ নভেম্বর একটি বেসরকারি ব্যাংকে হিসাব খোলা হয়। ২০২২ সালের ২৫ এপ্রিল পর্যন্ত শুধু ঐ হিসাবে জমা হওয়া অর্থের পরিমাণ প্রায় ৩৫ কোটি ২৮ লাখ টাকা।

অভিযোগপত্রে আরো বলা হয়, ২০১২-১৩ থেকে ২০১৯-২০ করবর্ষ পর্যন্ত আয়কর নথিতে ফেরদৌসী সুলতানা যে হিসাব উল্লেখ করেছেন, তা গ্রহণযোগ্য নয়।

শামসুদ্দোহা ও ফেরদৌসীর চার সন্তান। দুদক বলছে, সন্তানদের তারা ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে পড়িয়েছেন। তিনজনকে পড়িয়েছেন যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডায়। সন্তানদের পড়াশোনা এবং সংসারের ব্যয় মিটিয়ে শামসুদ্দোহা ও তার স্ত্রী যে সম্পদ অর্জন করেছেন, তা জ্ঞাত আয়-বহির্ভূত।

ফেরদৌসী দুদকে দাখিল করা সম্পদ বিবরণীতে সম্পদের উৎস হিসেবে স্বামীর দেশে-বিদেশে চাকরি, যুক্তরাজ্যে নিজের তিন বছরের চাকরি, কৃষি খামার ও ব্যবসার আয় এবং মায়ের দান, জমি ও ফ্ল্যাট বিক্রির কথা উল্লেখ করেন। তবে দুদক আদালতে জানিয়েছে, এই উৎসগুলোর পক্ষে ফেরদৌসী প্রমাণপত্র জমা দেননি। শামসুদ্দোহার কাছ থেকেও প্রমাণপত্র পাওয়া যায়নি।

আদালতকে দুদক জানিয়েছে, প্রমাণপত্র জমা দেওয়ার জন্য শামসুদ্দোহা ও ফেরদৌসীকে কয়েদ দফা নোটিশ দেওয়া হয়েছিল। তারা কোনো বক্তব্য দেননি, নথিপত্রও জমা দেননি। অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে, ফেরদৌসীর ব্যাংক হিসাবে অস্বাভাবিক লেনদেন তার স্বামী শামসুদ্দোহার অবৈধ উপায়ে অর্জিত অর্থ বলে পরিলক্ষিত হয়।

দুদকের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) মীর আহমেদ আলী সালাম বলেন, সাবেক অতিরিক্ত আইজিপি পদমর্যাদার একজন সরকারি চাকরিজীবী ও তার স্ত্রীর ব্যাংক হিসাবে বিপুল অর্থের লেনদেনের ঘটনা অস্বাভাবিক। দুদক অভিযোগ প্রমাণের জন্য তথ্য-প্রমাণ আদালতে জমা দিয়েছে।

এদিকে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ অস্বীকার করে শামসুদ্দোহা জানান, দুদকের মামলাটি আদালতে বিচারাধীন। তিনি জামিনে আছেন। তারা বিষয়টি আইনিভাবে মোকাবিলা করছেন। তাদের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চলছে।

নিউজটি শেয়ার করুন

© All rights reserved © jamunanewsbd.com
Design, Developed & Hosted BY ALL IT BD